অধ্যাপক সুগত মারজিৎ , কিছুদিন আগে ৪-১১-২০১৪ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় “ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে কিছু
অপ্রিয় সত্য” কথা বলেছেন । শুধু তাঁর কথা নয় , তিনি প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা ‘এই সমস্যা ----‘
(৩০-০৯-২০১৪ তারিখে প্রকাশিত ) বিষয়ে কোন
কোন পাঠকের করা সমালোচনার জবাব দেওয়ার
চেষ্টাও করেছেন । পরোক্ষে অধ্যাপক চক্রবর্তীর পক্ষ সমর্থনে দু- চার কথা বলেছেনও ।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ , শিক্ষক ,এবং উচ্চ- শিক্ষার অন্যতম প্রশাসক হিসাবে ,
অধ্যাপক মারজিৎ , ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি
বিরোধীতা না করেও , এই ধরণের আন্দোলনে যুক্ত , বা যুক্ত হতে ইচ্ছুক ছাত্র-
ছাত্রীদের , ব্যাক্তিগত লাভ- ক্ষতির হিসাব করে , আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন ।
চাকরী সূত্রে বিভিন্ন প্রয়োজনে অধ্যাপক মারজিৎ -এর
কাছাকাছি আসার এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গী জানার সুযোগ আমার হয়েছে । সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে
বর্তমানের অভিজ্ঞতার খুব একটা গরমিল আছে বলে মনে হয় না । মাস্টারমশাই এবং শিক্ষণ- ব্যবস্থার প্রসাশক হিসাবে
, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ‘ব্যক্তি’ ছাত্রকে স্মরণ
করিয়ে দিয়েছেন , তাদের স্বপ্নপুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই শুধু নয় এখানকার ঝাঁ
চকচকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
ক্যাম্পাসে , যাদবপুরের মত কৌম- দীপ্ত প্রতিবাদ ,প্রবল নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে না
।এবং তা পারে না কেবলমাত্র ব্যক্তি অনীহার কারণে ।সেখানে কয়েক হাজার টাকা মাসে
টিউশন ফি বাবদ দিতে হয় । তাই লাভ ক্ষতির ব্যাল্যান্স সীট , ছাত্র-ছাত্রীর পঠন-পাঠন ও শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে ,
তদের সবসময় শাসন করে চলে । ছাত্র জীবনের দর্শনকে সূচীমুখ করে তোলে ঃ- “টাকা
দাও ভর্তি হও , কোর্সের নির্ধারিত সময়টা অতিবাহিত কর । তারপর শংসা পত্র নিয়ে
“বাজারে” নেমে পর” । মূল দর্শন হল , নিজেকে
পণ্য হিসাবে সাজিয়ে বিক্রয় যোগ্য করে তোলা । অস্বীকার করার উপায় নেই , যে , আমাদের
সকলের অন্তিম লক্ষ্য সেটা হলেও , কখনই সেটা দর্শন হতে পারে না । একটি যুবক বা
যুবতী তাদের ছাত্র জীবনে একক ও সর্ব বিচ্ছিন্ন স্বাতন্ত্র্যকে সামনে রেখে নিজেকে
লক্ষাধীক মূল্যের পণ্য হিসাবে গড়ে তুলবে , তার আর কোন দর্শন থাকবে
না , এটাই কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র দর্শন ? আমরা কি এটাই আমাদের
ছাত্রছাত্রীকে শেখাব , যে তারা যেন, অপরচুনিটির সর্বাধিক সদ্ব্যবহার করে, শিক্ষার কস্ট- এর যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করে । কারণ , সেটাই একমাত্র সফলতার কাঙ্ক্ষিত পথ ।
অধ্যাপক মারজিৎ কি তাঁর ছাত্র জীবনে
এ-ভাবেই ভাবতেন ?
শিক্ষণ- ব্যবস্থার প্রশাসক হিসাবে সরকারী সাহায্য
পুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলনের আধিক্যকে তিনি এভাবেই কস্ট- ভিত্তিতে সরলীকরণ করেছেন । তাঁর ব্যাখ্যা দেখে মনে
হয়েছে পড়ার কস্ট যত কম হবে , অপরচুনিটির
প্রাপ্তব্যতা ততই কম হবে । আর তাই হয়ত এই
সব ক্ষেত্রে , তিনি অধ্যাপক দীপেশ
চক্রবর্তীর খুব সাধারন প্রকল্পিত বক্তব্য
, “পরে দেখে নেব” –কে যুক্তিসঙ্গত বলতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বা বিলম্ব করেন নি ।
অধ্যাপক মারজিৎ টিউশন ফি-র সাথে অপরচুনিটি
কস্ট-কে একই সরলরেখায় রেখে উদার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমূখী বিশ্বায়নের সত্যকেই , প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত
করেছেন । তাই অধ্যাপক মারজিৎ -এর অপ্রিয় সত্যকে আমরা যত দ্রুত প্রিয় সত্য হিসাবে
মেনে নিতে পারব , তত দ্রুত যাদবপুরের কৌম- দীপ্ত
আন্দোলনকে আমরা বিচ্ছিন্ন করতে পারব । তার অন্তিম দিন ঘোষণা করতে পারব ।
কথাটা মানতে অসুবিধা ছিল না । কিন্তু প্রশ্ন হল
,সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কলেজের অভ্যন্তরের ( কলেজের নাম লিখতে গেলে লেখার আয়তন বেড়ে যাওয়ার ভয় আছে ) বহিরাগতদের শিক্ষণ পুষ্ট “ছাত্র- বিক্ষোভ- আন্দোলন” (এই শব্দ-বন্ধটি
সংবাদপত্র থেকে ধার করা ) , অথবা প্রেসিডেন্সীর ‘গেট- ভাঙ্গা’ “ছাত্র- বিক্ষোভ-
আন্দোলন”-এর ‘অপরচুনিটি কস্ট’ অধ্যাপক মারজিৎ কিভাবে করবেন ? অথবা কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ের
সিন্ডিকেটের সভায় বিক্ষুব্দধ ছাত্র- নেতার
দলবল সহ পাণ্ডা গিরি করার জন্য প্রবেশ এবং
শিক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনের অপরচুনিটি নেওয়ার চেষ্টাকে অধ্যাপক
মারজিৎ কি তাঁর “অপ্রিয় সত্য” কথনের সাথে
যুক্ত করবেন ?
মনে হয় , যাদবপুরের ছাত্র-
ছাত্রীর কৌমতা “ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মুখী বিশ্বায়নের” পরিপ্রেক্ষিতে যতটা অপ্রিয় , ছাত্র-
বিক্ষোভ- আন্দোলন , বা , বহিরাগতদের আনুকূল্যে ছাত্র সংগঠনের ভাঙচুর , সরকার পোষিত
সম্পত্তির ছত্রখান , ততটা অপ্রিয় ত’ নয়ই , বরং হয়ত প্রিয় । কারণ এই ভাঙচুর “হয়ত”
ক্যাপিটালের রি- সাইক্লিং অপরচুনিটি সৃষ্টির সহায়ক , তাই এটা অতটা অপ্রিয় নয় !
যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনের
সুত্রপাত যে বিষয় নিয়ে হয়েছিল , শুনেছি , (প্রথমে অধ্যাপক চক্রবর্তীর লেখায় , পরে
অন্য একটি পত্রিকায় অধ্যাপক অনুষ্টুপ বসুর লেখায় ) বিদেশে না’ কি’ সে রকম বিষয়গুলি
আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির দৌত্যতায়
, শুধু মাত্র আর্থিক ক্ষতিপূরণের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগতস্তরে মিটিয়ে ফেলা হয় । যৌথ প্রতিবাদের ভাষা সৃষ্টির
কোন অবকাশ দেওয়া হয় না । “গণতান্ত্রিক বাতাবরণে অর্থকে বিনিময়ের মাধ্যম করে”
পণ্যের আদানপ্রদান হয় । সমাজের বৌদ্ধিক ট্র্যাডিশনকে জাগ্রত না করে ,
ব্যক্তিকেন্দ্রিক “স্বার্থ পুষ্টি ও ভালমন্দের
মূল্যভিত্তিক বিবেচনা” সর্বোপরি ক্ষয়ক্ষতির লাভ লোকসানের হিসাব কষে নেওয়া হয় ।
অধ্যাপক মারজিৎ , এই দিকটাও ভেবে দেখতে
বলেছেন । কারন তিনি মনে করেন , প্রথমত , আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আদর্শ ও মুল্যবোধকে ছাত্র- কৌম ভুক্ত করা অপেক্ষা, ব্যক্তি স্বার্থ পূরণের অপরচুনিটির সন্ধান করা অনেকবেশী শ্রেয় । তারপর না হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ দরদাম ঠিক করে ,এই বাঙলার বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর
হালফিল ফেলে রাখা পাদুকায় পা গলিয়ে , আন্দোলনে অংশ নেওয়া যাবে । তাতে মনে হয়, আন্দোলন উত্তর কালে কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা
থেকে যায় । অধ্যাপক মারজিৎ-এর বিশ্বাস ,
এভাবেই আপাতত লক্ষের প্রতি সূচিমুখ আন্দোলনের রাশ টেনে ধরা যাবে , এবং নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্টা করা যাবে ।
ধন্যবাদ , অধ্যাপক সুগত মারজিৎকে
, ছাত্রছাত্রী এবং সমাজের অন্যান্য কৌম অংশকে এইরূপ “অপ্রিয় সত্য” কথা বলার জন্য ।
No comments:
Post a Comment