ধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ৮
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 05
24th. June, 1942, Wednesday.
প্রিয় কিটী,
প্রচণ্ড গরম পড়ে গেছে। বলতে পার বাড়ির মধ্যেই গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এই গরমে, ভাবতে পার আমাদের হেঁটে যেতে হচ্ছে। কারণ আমাদের সাধারণের জন্য সংরক্ষিত যানে যাওয়ার সরকারী অনুমতি নেই। যেখানেই যাব সেখানেই হয় আমাদের হেঁটেই যেতে হবে অথবা সম্ভব হলে পা-দানি ওয়ালা টমটম গাড়ীতে যেতে পারি। হাঁটার সময় যখন পাশ দিয়ে, ট্রামগুলোকে যেতে দেখছি, তখন আবার নতুন করে অনুভব করছি ট্রামগুলো সত্যিই কি সুন্দর ছিল। কিন্তু কি করব, আমরা ইহুদি, আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, আমরা ট্রামে চড়তে পারব না। আমাদের যাতায়াতের জন্য সরকারী হুকুমে বরাদ্দ শুধু পা-দানি ওয়ালা ট্মটম গাড়ী। আমাদের জন্যে সেই ভাল। জান, কাল দুপুরবেলায়, মধ্যাহ্ন ভোজের আগে, আমায় “জান-লুকেনস্ট্রাটে (Jan-Lukenstraat) দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত দেখাতে যাওয়ার কথা ছিল। আমায় যেতেও হয়েছিল। বলতে পার প্রায় হেঁটেই। জায়গাটা ঠিক কোথায় জান? স্ট্যাডসটিয়ারটউনেন (Stadstimmertuinen), যেখানে আমাদের স্কুল, সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আর সবসময় ত’ অত দূরের জন্য টমটম গাড়ী পাওয়া যায় না । ওখান থেকে ঘুরে এসে আমাকে আবার সরাসরি স্কুলে যেতে হয়েছিল। অতটা পথ ঘুরে দাঁত দেখিয়ে এসে তারপর স্কুলে আসা। এত ক্লান্ত লাগছিল যে বিকালের দিকে স্কুলে বসে বসেই আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যভাল, খিদে তেষ্টা পায় নি। আসলে দাঁতের ডাক্তারের সহকারিনী ভদ্রমহিলা খুব ভাল আর বেশ দয়ালু ছিলেন। আমি যখন ডাক্তারের ওখানে বসে ছিলাম, তখন উনি আমায় একগ্লাস শরবৎ খেতে দিয়েছিলান। সত্যিই ওই মহিলার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওইটুকু না পেলে, আমি কি করে যে থাকতাম, কে জানে!
Merwedeplein এর সেই বাড়ি যেখানে অ্যানি ও তার পরিবার ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বাস করত।
টমটম ছাড়া আমাদের কেবল ফেরী পথে পারাপার করার অনুমতিও আছে। সুতরাং কোথাও যেতে হলে, হয় ট্মট্ম গাড়ী অথবা ফেরী পারাপার, এই আমাদের জন্য বর্তমানে যাতায়াতের বন্দোবস্ত। জোসেফ ইসরেলস্কেড ( Josef Israelskade ) থেকে কেবল একটাই মাত্র নৌকা আছে। আমরা যখনই কোথাও যাব বলি, নৌকার মাঝি আমাদের বিনা বাক্যে তৎক্ষণাৎ সেখনে নিয়ে যায়। অন্যথা করে না। বলতে পার এটাই আমাদের ভাগ্য। তাই বলছিলাম, আমাদের এই অসহনীয় অবস্থার জন্য কখনই হল্যান্ডবাসীকে দায়ী করা বা দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তারা ত’ আমাদের জন্য এই নিয়ম করে নি। বরং তারা আমাদের যাওয়া আসার এই অসুবিধাটা উপলব্ধি করে। আর তার জন্যে সাহায্যও করে।
এর মধ্যেই একটা ভাল খবর হলো, আমাকে এখন হয়তঃ আর স্কুলে যেতে হবে না। এর প্রাথমিক কারণ হলো, গত ইস্টারের ছুটির সময় আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, আমার বাবা তার সুন্দর টাকা রাখার বাক্সটা তাঁর এক বিশ্বস্ত খ্রিস্টান পরিবারের কাছে নিরাপদে রাখার জন্য দিয়েছে। তাই যাওয়ার হাতখরচের টাকাও তিনি এখন দিতে পারবেন না, অথবা নতুন সাইকেলও কিনে দিতে পারবেন না। ভগবানের দয়ায়, আমাদের স্কুলে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ছুটি শুরু হবে। অতএব, আর মাত্র এক সপ্তাহ কাটাতে পারলেই স্কুল যাওয়া সংক্রান্ত এই দুঃশ্চিন্তা থেকে আমি মুক্তি পাব। জান, গতকাল একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি কিছুটা আনমনে সাইকেল রাখার শেডের পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। চমকে উঠে, চার দিকে তাকিয়ে খুঁজে দেখি, একটি সুন্দর দেখতে ছেলে আমায় ডাকছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎই মনে পড়ে গেল, আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় আমার বন্ধু ইভার বাড়ীতে ছেলেটির সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ল ছেলেটি বেশ লাজুকের মতো আমার দিকে পরিচয় করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। নিজের নাম বলেছিল হ্যারী গোল্ডবারগ (Harry Goldberg )।
হ্যারী গোল্ডবারগ, ( আসল নাম, হেলো সিল্ভারবুরগ-Hello Silberburg, সিল্ভারবুরগ ওরফে গোল্ডবারগের এই ছবিটি ১৯৭৮ সালে তোলা) আত্মগোপনের আগে অ্যানির প্রথম রোমান্টিক সম্পর্ক এঁর সাথে গড়ে ওঠে।
ওকে আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে, আমি প্রথমে একটু অপ্রস্তুত আর অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ও আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসছে কেন! তবে কথাটা বেশীক্ষণ আমায় ভাবতে হয় নি। কারণ সে-ই সরাসরি আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘সে আমার সাথে স্কুলে যেতে পারে কি’না!! আমিও বললাম, “আমি যে দিকে স্কুলে যাব, তুমিও ত’ সেদিক দিয়েই স্কুলে যাবে। তাই তোমার সাথে একসাথে স্কুলে যেতে আমার কেন কোনও আপত্তি থাকবে!!” এ’রকমই একটা উওর আমি মজা করেই তাকে দিয়েছিলাম। তারপর অবশ্য ওর সাথেই আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। জান, হ্যারীর বয়স, আমার আন্দাজ ষোল হবে। হ্যারী একসাথে যাওয়ার সময় বিভিন্ন রকম মজার মজার কথা বলত। আমার বেশ ভাল লাগত। পরের দিন সকালেও দেখি, হ্যারী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মনে হয়, এখন থেকে হ্যারী আমার জন্য এ’ভাবেই অপেক্ষা করবে।
ইতি,
অ্যানি
No comments:
Post a Comment