Thursday 25 August 2016

ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ৮
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 05
24th. June, 1942, Wednesday.


প্রিয় কিটী,

প্রচণ্ড গরম পড়ে গেছে। বলতে পার বাড়ির মধ্যেই গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এই গরমে, ভাবতে পার আমাদের হেঁটে যেতে হচ্ছে। কারণ আমাদের সাধারণের জন্য সংরক্ষিত যানে যাওয়ার সরকারী অনুমতি নেই। যেখানেই যাব সেখানেই হয় আমাদের হেঁটেই যেতে হবে অথবা সম্ভব হলে পা-দানি ওয়ালা টমটম গাড়ীতে যেতে পারি। হাঁটার সময় যখন পাশ দিয়ে, ট্রামগুলোকে যেতে দেখছি, তখন আবার নতুন করে অনুভব করছি ট্রামগুলো সত্যিই কি সুন্দর ছিল। কিন্তু কি করব, আমরা ইহুদি, আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, আমরা ট্রামে চড়তে পারব না। আমাদের যাতায়াতের জন্য সরকারী হুকুমে বরাদ্দ শুধু পা-দানি ওয়ালা ট্মটম গাড়ী। আমাদের জন্যে সেই ভাল। জান, কাল দুপুরবেলায়, মধ্যাহ্ন ভোজের আগে, আমায় “জান-লুকেনস্ট্রাটে (Jan-Lukenstraat) দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত দেখাতে যাওয়ার কথা ছিল। আমায় যেতেও হয়েছিল। বলতে পার প্রায় হেঁটেই। জায়গাটা ঠিক কোথায় জান? স্ট্যাডসটিয়ারটউনেন (Stadstimmertuinen), যেখানে আমাদের স্কুল, সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আর সবসময় ত’ অত দূরের জন্য টমটম গাড়ী পাওয়া যায় না । ওখান থেকে ঘুরে এসে আমাকে আবার সরাসরি স্কুলে যেতে হয়েছিল। অতটা পথ ঘুরে দাঁত দেখিয়ে এসে তারপর স্কুলে আসা। এত ক্লান্ত লাগছিল যে বিকালের দিকে স্কুলে বসে বসেই আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যভাল, খিদে তেষ্টা পায় নি। আসলে দাঁতের ডাক্তারের সহকারিনী ভদ্রমহিলা খুব ভাল আর বেশ দয়ালু ছিলেন। আমি যখন ডাক্তারের ওখানে বসে ছিলাম, তখন উনি আমায় একগ্লাস শরবৎ খেতে দিয়েছিলান। সত্যিই ওই মহিলার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওইটুকু না পেলে, আমি কি করে যে থাকতাম, কে জানে! 

Merwedeplein এর সেই বাড়ি যেখানে অ্যানি ও তার পরিবার ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বাস করত।

টমটম ছাড়া আমাদের কেবল ফেরী পথে পারাপার করার অনুমতিও আছে। সুতরাং কোথাও যেতে হলে, হয় ট্মট্ম গাড়ী অথবা ফেরী পারাপার, এই আমাদের জন্য বর্তমানে যাতায়াতের বন্দোবস্ত। জোসেফ ইসরেলস্কেড ( Josef Israelskade ) থেকে কেবল একটাই মাত্র নৌকা আছে। আমরা যখনই কোথাও যাব বলি, নৌকার মাঝি আমাদের বিনা বাক্যে তৎক্ষণাৎ সেখনে নিয়ে যায়। অন্যথা করে না। বলতে পার এটাই আমাদের ভাগ্য। তাই বলছিলাম, আমাদের এই অসহনীয় অবস্থার জন্য কখনই হল্যান্ডবাসীকে দায়ী করা বা দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তারা ত’ আমাদের জন্য এই নিয়ম করে নি। বরং তারা আমাদের যাওয়া আসার এই অসুবিধাটা উপলব্ধি করে। আর তার জন্যে সাহায্যও করে। 

এর মধ্যেই একটা ভাল খবর হলো, আমাকে এখন হয়তঃ আর স্কুলে যেতে হবে না। এর প্রাথমিক কারণ হলো, গত ইস্টারের ছুটির সময় আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, আমার বাবা তার সুন্দর টাকা রাখার বাক্সটা তাঁর এক বিশ্বস্ত খ্রিস্টান পরিবারের কাছে নিরাপদে রাখার জন্য দিয়েছে। তাই যাওয়ার হাতখরচের টাকাও তিনি এখন দিতে পারবেন না, অথবা নতুন সাইকেলও কিনে দিতে পারবেন না। ভগবানের দয়ায়, আমাদের স্কুলে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ছুটি শুরু হবে। অতএব, আর মাত্র এক সপ্তাহ কাটাতে পারলেই স্কুল যাওয়া সংক্রান্ত এই দুঃশ্চিন্তা থেকে আমি মুক্তি পাব। জান, গতকাল একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি কিছুটা আনমনে সাইকেল রাখার শেডের পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। চমকে উঠে, চার দিকে তাকিয়ে খুঁজে দেখি, একটি সুন্দর দেখতে ছেলে আমায় ডাকছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎই মনে পড়ে গেল, আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় আমার বন্ধু ইভার বাড়ীতে ছেলেটির সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ল ছেলেটি বেশ লাজুকের মতো আমার দিকে পরিচয় করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। নিজের নাম বলেছিল হ্যারী গোল্ডবারগ (Harry Goldberg )।


হ্যারী গোল্ডবারগ, ( আসল নাম, হেলো সিল্ভারবুরগ-Hello Silberburg, সিল্ভারবুরগ ওরফে গোল্ডবারগের এই ছবিটি ১৯৭৮ সালে তোলা) আত্মগোপনের আগে অ্যানির প্রথম রোমান্টিক সম্পর্ক এঁর সাথে গড়ে ওঠে। 

ওকে আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে, আমি প্রথমে একটু অপ্রস্তুত আর অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ও আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসছে কেন! তবে কথাটা বেশীক্ষণ আমায় ভাবতে হয় নি। কারণ সে-ই সরাসরি আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘সে আমার সাথে স্কুলে যেতে পারে কি’না!! আমিও বললাম, “আমি যে দিকে স্কুলে যাব, তুমিও ত’ সেদিক দিয়েই স্কুলে যাবে। তাই তোমার সাথে একসাথে স্কুলে যেতে আমার কেন কোনও আপত্তি থাকবে!!” এ’রকমই একটা উওর আমি মজা করেই তাকে দিয়েছিলাম। তারপর অবশ্য ওর সাথেই আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। জান, হ্যারীর বয়স, আমার আন্দাজ ষোল হবে। হ্যারী একসাথে যাওয়ার সময় বিভিন্ন রকম মজার মজার কথা বলত। আমার বেশ ভাল লাগত। পরের দিন সকালেও দেখি, হ্যারী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মনে হয়, এখন থেকে হ্যারী আমার জন্য এ’ভাবেই অপেক্ষা করবে।

ইতি,
অ্যানি

Sunday 21 August 2016




শিক্ষ্মা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন ও তার প্রশাসনিক পরিচালনার প্রাসঙ্গিক আলোচনা।

                                          সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।
                                  

সময় ও সমাজের সাথে তাল রেখে বর্তমানে লেখাপড়ার ধরণ ও তার ক্ষেত্রের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। একই সাথে অভিভাবক ও সম্ভাব্য বা ভবিষ্যাপেক্ষ ছাত্র- ছাত্রীর মানসিকতা ও প্রত্যাশার পরিবর্তনও ঘটে চলেছে চাকুরিজীবি মধ্যবিত্ত ও নব্য উদ্যোগশালী বিত্তবানগণ বর্তমানে তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে শিক্ষাকে ক্রয় করতে চাইছেন। এবং তা যে কোন মূল্যে। তাদের চাহিদা এখন শুধু ভাল শিক্ষা, নামী শিক্ষক, বা বিদ্বতমহলে পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি নিবদ্ধ নেই। এখনকার চাহিদা হল ঃ- ১) ভাল পরিকাঠামো বিশিষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ; ২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর জন্য সুবিধাযুক্ত যানবাহন ব্যবস্থা ; ৩) ছাত্রছাত্রীর পোষাক-পরিচ্ছদের বিশিষ্ঠতা ; ৪) পশ্চিমায়িত আধুনিকতার  কৌলীন্যে স্বীকৃত ও পাশ্চাত্য ভাষার উপর স্থিত পঠন-পাঠন ব্যবস্থা  ; এবং  ৫) শিক্ষার মাধ্যম, শংসাপত্র প্রদানের সংস্থা, পরিকাঠামোগত কৌলীন্যের সাধারণ স্বীকৃতি, ইত্যাদিএই পরিষেবাগুলির  প্রাপ্তব্যতা একদিকে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে তেমনি, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মূল্যও নির্ধারণ করে। একই ভাবে অভিভাবককুল এই প্রাপ্তব্যতার  বিনিময়ে যে কোন মূল্য, শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে দ্বিধা করেন  না। যারা পারেন না, তাঁরা সামাজিকভাবে হীনমন্যতার শিকার হন। এমন কি পারিবারিকভাবেও কিছুটা “দলছুটের” মত আড়ালে থাকেন। এটাই এখন শহুরে শিক্ষার অন্যতম অভিমুখ। এ’কথা বলা যেতেই পারে যে , শুধু শহর নয়, আধা- শহর বা গঞ্জেও এই ধারা ও মানসিকতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, এখন মনে হয়, অভিভাবকদের অন্তিম লক্ষ্য “শিক্ষিতের গৌরবজনক” স্বীকৃতি নয়, বরং, মুলধনি দ্রব্য বা Capital Product হিসাবে শিক্ষিতের সামাজিক মূল্যায়ন।

এই রকম একটি পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বর্তমান প্রসঙ্গে যে দুটি দিক বা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি, তা’হল, প্রথমতঃ, পরিবর্তিত চাহিদার প্রেক্ষিতে বুনিয়াদি স্তর থেকে শিক্ষার উচ্চতম স্তরে যে পরিকাঠামোগত ও অভিমুখগত পরিবর্তন হয়েছে, তার ওপর আলোকপাত করার  চেষ্টা । কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গীগত পরিবর্তনের মধ্যেই নিহিত আছে, শিক্ষার “চরিত্রগত” পরিবর্তনের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। আলোচনার দ্বিতীয় অংশে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, কিভাবে এই পরিবর্তিত পরিকাঠামোর মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের প্রশাসন বা / এবং পরিচালন ব্যবস্থাকে অর্থবহ ও কার্যকর করে তোলা যায় তার সম্ভাব্য অভিভাষণ। দুটি অংশের মধ্যে একটি আবশ্যিক যোগসূত্র আছে। একদিকে ব্যক্তির আর্থিক স্বাচ্ছল্যতা ও তার ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে কিরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশা করে;  অন্যদিকে শিক্ষাকে কিভাবে বর্তমানের উপযুক্ত করে তোলা যায়,এবং অভিভাবকের প্রত্যাশা পূরণ করা যায়, তার প্রচেষ্টা। কার্যত শিক্ষার সাফল্য নির্ভর করে, এই দুটি প্রসঙ্গের মেলবন্ধনের ওপর।
আমাদের আলোচনার প্রথম প্রসঙ্গ বিষয়ে আমরা যেটা বলতে চাইছি, তা’হল, গত বিংশ শতকের সত্তর-আশির দশকেও সমাজে শিক্ষার প্রসার ও বিস্তারে প্রধান ভূমিকা ছিল রাষ্ট্র  বা সরকারের। আর এই ভূমিকার প্রধান চালিকা শক্তি ছিল, সরকারের  প্রতি সংবিধান প্রণেতাদের একটি লিখিত নির্দেশ। সংবিধানের রাষ্ট্র  পরিচালনার নীতির অন্তর্ভুক্ত এই নির্দেশ অনুসারেই সরকারের অভ্যন্তরে শিক্ষা নীতি যেমন তৈরী করা হত, তেমনি শিক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করাও ছিল সরকারের নৈতিক কর্তব্য। বিশেষ করে সরকারের আর্থিক মূলধনে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান গুলো ছিল সরকারের “জনকল্যাণমুখী কর্মসূচীর” উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্তকে সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে আশীর দশকের মধ্যভাগে, সরকার শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরাজির জায়গায় মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের  প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমের দিকে তাকালে, এই চেষ্টার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমাদের রাজ্যের শিক্ষিত, পেশাজীবী মধ্যবিত্ত কিছুতেই এই বিষয়কে মন থেকে মেনে নিতে পারেন  নি। বরং তাদের চোখে, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষার আধিপত্য, তার এতদিনকার “এলিট” কৌলীন্যকে আঘাত করবে। বুনিয়াদি ও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষিতদের কাছে উচ্চশিক্ষার দরজা কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। এমন কি তারা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রতিযোগিতায় শুধু পিছিয়েই পড়বে না, উপরন্তু ছিটকে যাবে। এটা শুধু তারা মনেই করেন নি, উপরন্তু, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এক অজানা উৎকণ্ঠাও সৃষ্টি হয়।  এই উৎকণ্ঠাকে মধ্যবিত্ত সমাজ  সহজ মনে মেনে নিতে পারে নি। তবে মাতৃভাষার স্বপক্ষে বেশ কিছু নৈতিক যুক্তি আর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির উদাহরণ থাকার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিরোধীতা গড়ে তুলতে সাহস করে নি।  

পরিবর্তে,এই বিরোধিতা এক ভিন্নতর বিকল্প পথ গ্রহণ করেছিল। আশীর দশকের মাঝ থেকেই,পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে গড়ে উঠতে শুরু করে  প্রাথমিক স্তরের “ইংরাজি মিডিয়াম” স্কুল। মধ্যবিত্তের আনুকূল্যে এই সব স্কুলগুলির দাপট যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি, সরকার পোষিত প্রাইমারী স্কুলগুলির শরীর কঙ্কালসার হতে শুরু করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার মানেও আসে এক অজানা ভাটার টান। উদ্বিগ্ন মধ্যবিত্তের এবং নয়া বিত্তবানের স্বাভাবিক লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তাদের ছেলেমেয়েদের যেমন করেই হোক ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল, তাঁরা প্রাইমারী স্তরের পরই ছেলেমেয়েদের মিশনারি স্কুলগুলিতে ভর্তি করার চেষ্টা শুরু করল। আর এক অংশের লক্ষ্য ছিল সরকারী স্কুল, অথবা অপেক্ষাকৃত এলাকা ভিত্তিক নামী স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাবলা যায় এই সময় থেকেই, অভিভাবকদের লক্ষ্য হয়ে উঠল, “শিক্ষা” অপেক্ষা, বাজার ভিত্তিক শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা।

বিংশ শতকের নব্বই দশকে, এই পরিবর্তিত মানসিকতায় এল নতুন এক পরিবর্তনের বৈপ্লবিক ঢেউ। উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বায়নের নতুন প্লাবনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু বৈপ্লবিক শর্ত প্রায় বিনা বাধায় জায়গা করে নিল। সংবিধান প্রণেতাগণের নির্দেশিত ( Directed) নীতিগুলি ( Principles)-কে পিছিয়ে দিয়ে, এগিয়ে এল বিশ্বায়নের দায়বদ্ধ” শর্ত । শর্তের প্রতি মান্যতা দিতে, সরকার মাধ্যমিক পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষার দরজা দেশি-বিদেশী সকল শিক্ষা বান্ধব সঞ্চিত মূলধনের সামনে খুলে দিতে বাধ্য হল। অবশ্য সেখানে সরকারী পোষণ ও  অংশীদার হওয়ার পথেও কোন বিধিনিষেধ  ছিল না।
আমাদের মধ্যে একটি প্রচলিত সামাজিক উপলব্ধি আছে। তা’হল, বুনিয়াদি, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষার বিস্তার, সমাজে শিক্ষার আলো সঞ্চার করে। আর, পরবর্তী পর্যায়ের বিষয় ভিত্তিক বা প্রয়োগ ভিত্তিক শিক্ষার আলো, সমাজকে “এলিট” বিচ্যুরিত আলোয় আলোকিত করে। সুতরাং বিশ্বায়নের ফলে, শিক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক আলো সঞ্চারের ভার সরকারের “জনকল্যাণের” অভিমুখ হিসাবে থাকলেও, “এলিট” আলো বিচ্যুরনের বড় অংশীদার হয়ে উঠল সরকারের “বাজেট” নির্ধারিত অর্থ- অঙ্কের পাশাপাশি, দেশী-বিদেশী শিক্ষা- বান্ধবের সঞ্চিত মূলধনের থলি। এই সময় থেকেই আমাদের রাজ্যে গড়ে উঠতে থাকল, শিক্ষা-বান্ধবের সঞ্চিত মূলধনে, বিভিন্ন প্রয়োগ ও পেশা ভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের বড় বড় শিক্ষা-সংস্থা । ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার প্রায়োগিক রূপ, পেশাদারী ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন দিক, ইত্যাদির প্রথাগত শিক্ষা ছিল এই সব সংস্থার অন্যতম অভিমুখ। শিক্ষা-বান্ধবের আনুকূল্যে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে একদিকে গড়ে উঠতে থাকে আধুনিক বাস্তু ভিত্তিক ঝাঁ চক-চকে ইঞ্জিনিয়ারিং ও পেশা কেন্দ্রিক বড় বড় কলেজ। অন্যদিকে, জয়েন্ট এন্ট্রান্সে প্রায়োগিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তির চেষ্টায়  আসে বন্যার প্লাবন। পাশাপাশি, ভিন্ন ধরণের এন্ট্রান্সের মাধ্যমে, ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তির প্রবণতা, অতটা না’হলেও, ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকে, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা। বলা যায়, এই সময় থেকেই, সরকার পোষিত কলেজ গুলির সিংহভাগ মধ্যবিত্ত ও নব্য বিত্তবানদের নিকট অপাংতেও হয়ে উঠতে শুরু করে। এককথায় তারা তাদের দীর্ঘ দিনের কৌলীন্য হারাতে আরম্ভ করে। 
  
নতুন “মূলধন পুষ্ট” শিক্ষা বান্ধবদের প্রথমিক লক্ষ্য ছিল, নিজের নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক পরিকাঠামোকে দৃশ্যত আধুনিক ও উজ্জ্বল করে তোলা। যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা ক্রয়ে ইচ্ছুক মধ্যবিত্ত ও নব-বিত্তশালী  ক্রেতাগন, তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অভ্যন্তরের শিক্ষা প্রদানের পরিকাঠামো  অপেক্ষা, তাঁরা জোর দেন, বাহ্যিক পরিকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের উপর। তাদের পরিকাঠামো ও সুযোগসুবিধার ঔজ্জ্বল্য যত বেশী বিজ্ঞাপিত হবে, তত বেশী তাদের প্রতিষ্ঠানের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এই ছিল বিশ্বাস। এককথায়, সম্ভাবনাপূর্ণ মানব সম্পদের যোগান তাদের ক্রম বর্ধিত  চাহিদার অনুপাতে বৃদ্ধি পেলে, তাদের পরিকাঠামো বিনির্মাণে বিনিয়োগকৃত মূলধন শুধু সুরক্ষিতই থাকবে না, উপরন্তু তার দ্রুত বৃদ্ধিও সুনিশ্চিত হবে। সহজ কথায় শিক্ষা হয়ে ওঠে একটি পণ্য। যার ‘পটেনশিয়াল’ ক্রেতা আছে, নতুন বিক্রেতা হিসাবে “শিক্ষা-বান্ধব” গন উপস্থিত। আর সরকার ক্রমেই হয়ে উঠতে থাকে এই দুই প্রান্তের সমন্বয় সাধনকারী “আইনানুগ” সংস্থা।

প্রাথমিকভাবে যা উচ্চ-শিক্ষার ক্ষেত্রে শুরু হয়েছিল, তা’ নব্বই দশকের শেষে ও একবিংশ শতকের প্রথমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। ভিন্ন রাজ্য, ও কেন্দ্রীয় স্তরের শিক্ষা পরিচালন সংস্থার সহায়তায় শিক্ষা-বান্ধব বাণিজ্যিক পুঁজির মালিকগণ, আমাদের রাজ্যেও প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। আমাদের রাজ্যে শুধু শহরে নয়, শহরাঞ্চলেও দিল্লী বোর্ড, কেন্দ্রীয় বোর্ড-এর পাঠ্যসূচীর নিয়ন্ত্রণাধীন “ইংরাজী মিডিয়াম”, ডে-স্কুল গড়ে  উঠতে থাকে। তাদের পরিকাঠামোর চাকচিক্য, যে কোন বাণিজ্য  প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ভবনের চাকচিক্যকেও হার মানাতে সক্ষম। স্বভাবত মধ্যবিত্ত ও নব্য বিত্তশালীদের কাছে, এই পাওয়াটা ছিল বড় পাওয়া। এতদিন মনের মধ্যে যে হীনমন্যতাটুকু ছিল, এবার সে’টুকুও কাটিয়ে ওঠার সুযোগ অবশ্যই তাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তাই তারা তাদের সব  টুকু সামর্থ্য দিয়ে সুযোগ গ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর যারা  সেটা পারলেন না, তারা, হীনমন্যতার মধ্যে থেকেই ছেলেমেয়েকে আরও বেশী করে প্রতিযোগিতার বাজারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেনপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গড়ে উঠতে লাগল প্রায় সমান্তরাল “প্রাইভেট টিউশানির” বাজার। এখানে ভাল পড়ার অর্থ, ভাল নোট, ভাল নোটের অর্থ ভাল নম্বর, ভাল নম্বরের অর্থ ভাল জায়গায় পরবর্তী ধাপে সুযোগ পাওয়া। এই ‘ভাল’-র  কোন মাত্রা নেই, এই ‘ভাল’-র মাত্রা শুধু স্বপ্নের জায়গায়, স্বপ্নের বিষয় নিয়ে “পড়ার সুযোগ”।

আমাদের দেশের শিক্ষার মৌলিকতা ছিল এর বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানচর্চার ধারা। আমাদের এই চিরায়ত ধারায় নতুন করে জল সিঞ্চন ও প্রতিপালন করে,ঔপনিবেশিক শাসক বর্গ তাকে কার্যকরী মানবসম্পদে পরিণত করেছিলআর এটা হল  অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্তের ইতিহাসসেই ধারাবাহিকতায় স্রস্টা তার সৃষ্টির চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেত। বিংশ শতকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীতে এসে, এই মৌলিকতার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে। শিক্ষার এই বিশ্বায়ন ও উদারীকরণ, স্রস্টার প্রতি নিবদ্ধ “এলিটিয়” দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে সৃষ্টির প্রতি। মানব সম্পদের বিষয় ভিত্তিক মেধাশক্তির দৃষ্টি বর্তমানে মৌলিক জ্ঞানচর্চা থেকে সরে গিয়ে নিবদ্ধ হয়েছে প্রায়োগিক  জ্ঞান অর্জনের দিকে। এবং অর্জিত জ্ঞানকে পরিমাপ করা হচ্ছে, ব্যক্তির সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তির মাত্রা দিয়ে। অন্যদিকে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিস্তারে বাণিজ্যিক পুঁজির যে আনুভূমিক প্রসার ঘটেছে, তার ফলে, এই স্তরে ছাত্রছাত্রীর মেধা নির্ধারণের মাপকাঠিও বদলে গেছে। এখন অভিভাবকের অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, সমাজে এবং বাজারে তার মেধা কতটা বিনিময় মূল্য অর্জন করতে পারবে।  অথবা তার স্থান হবে মধ্যমেধা, নিম্নমেধা বর্গীয়দের সারীতে ? বিশেষ করে যাঁদের পুত্র-কন্যারা সরকার পোষিত স্কুলে পড়ে, তাঁদের মধ্যে এই ভয়ের ঘনত্ব অনেক বেশী। এই অপ্রত্যাশিত ভয় বা শঙ্কা কার্যত তাঁদের বাধ্য করত, সাধ্যের অতিরিক্ত প্রাইভেট-টিউশানিতে ব্যয় করে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার চেষ্টা করতে।
অতএব আমরা আমাদের প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় যে সব বিষয়গুলিকে শ্রোতা / বা বিশ্লেষকদের সামনে রেখেছি , সে’গুলি হল ঃ- 

প্রথমত, প্রচলিত ও গতানুগতিক শিক্ষার মধ্যে প্রথম পরিবর্তনের ঢেউ গত বিংশ শতকের আশীর দশকে দেখা যায়। বুনিয়াদি বা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলাকে চাকুরীজীবি মধ্যবিত্ত বা বিত্তবান ছোট-বড় ব্যবসায়ী অভিভাবকগণ মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা শিক্ষার মিডিয়াম হিসাবে, ইংরাজির ওপর বেশী ভরসা করতে চেয়েছিলেন।
 
দ্বিতীয়ত, গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে, বিশ্বায়নের হাত ধরে, উচ্চ-শিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের শিক্ষা বান্ধবদের  বাণিজ্যিক মূলধনের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। শিক্ষা সংক্রান্ত সাংবিধানিক নির্দেশাবলী কিছুটা হলেও শিথিল হয়ে পড়ে। শিক্ষার অভিমুখগত পরিবর্তন ঘটে।

 তৃতীয়ত, একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই, প্রাইমারী থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত “শিক্ষা-বান্ধবদের” বাণিজ্যিক মূলধনের আনুভূমিক  বিস্তার শুরু হয়। আর তাতে সহায়তা করে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের “এডুকেশন বোর্ড”। শিক্ষাকে ভিত্তি করে, সমাজে এক নতুন আনুভূমিক স্তর বিন্যাস ঘটে।

এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আমরা আমাদের আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে যাব। এই পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও পরিচালন ব্যবস্থা।

প্রশাসন ও পরিচালন, শব্দদুটি আপাতভাবে পৃথকবলে মনে হলেও, শব্দদুটি পারস্পরিক পূরকস্বরুপ। যেমন, প্রশাসন, একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে আইনানুগভাবে নিযুক্ত  ব্যক্তির মাধ্যমে, সংগঠনকে প্রশাসিত করে। উক্ত ব্যক্তির ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও আইনানুগভাবে অনমনীয় প্রত্যাদেশ হিসাবে, সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে, পরিচালন বা ম্যানেজমেন্টও আইনানুগভাবে নিযুক্ত ব্যক্তির মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। তবে পরিচালনের ধরণটা অনেকবেশী ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত বা “প্রাতিজনিক”। অর্থাৎ পরিচালক, সকল কর্মীবর্গকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের “লক্ষ্য বা গোল, ব্রত বা মিশন এবং দর্শন বা ভিষন” বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন। প্রশাসকের উদ্দেশ্যও “লক্ষ্য, ব্রত ও দর্শন"-কে বাস্তবায়িত করাকিন্তু তিনি তা করেন কর্মীবর্গের মাধ্যমে। তাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে ও বন্টিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি’না তার উপর প্রশাসক তাঁর সতর্ক নজর রাখেন। যে কোন বিচ্যুতিকেই প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করা হয়।

অর্থাৎ, প্রশাসক তাঁর নিজস্ব স্তর থেকে “স্টাফ” ও “লাইন” বর্গের মধ্যে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বার্থে দায়িত্ব বণ্টন করে দেন, এবং তার সম্পাদনের উপর সতর্ক নজর রেখে, প্রতিষ্ঠানের “লক্ষ্য, ব্রত ও দর্শন”-কে বাস্তবায়িত করেন। অন্যদিকে, পরিচালক “স্টাফ” ও “লাইন” বর্গকে “প্রাতিজনিক” পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করে, পারস্পারিক সহযোগিতাকে সামনে রেখে, প্রতিষ্ঠানের “লক্ষ্য, ব্রত ও দর্শনকে” বাস্তবায়িত করেন। সুতরাং উদ্দেশ্য এক হলেও কাজের ধারার মধ্যে ও আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে যে কোনভাবেই হোক না কেন, আসল বিষয় হল, প্রতিষ্ঠানের “লক্ষ্য, ব্রত ও দর্শন"। একেই সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বা ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। ক্যাম্পাস প্রধান,  প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসিত করবেন না পরিচালিত করবেন তা’ নির্ভর করে তাঁর নিজস্ব জীবন দর্শনের উপর। তিনি নেতা হবেন, না, শাসক হবেন, সেটা তিনি ঠিক করবেন। প্রতিষ্ঠানের সংবিধিবদ্ধ ( Statutory) সংস্থা কেবল নজর রাখবেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে কি’না । 

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্রীভূত করে এ’কে  অন্যনামে বা শব্দবন্ধে চিহ্নিত করা হতে থাকে।প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ এলাকাকে আমরা সাধারণভাবে “ক্যাম্পাস” বলে থাকি ক্যাম্পাস বা Campus  শব্দটি নীচের শব্দগুলির আদ্যক্ষর  নিয়ে গঠিত ঃ-

১) C-omprehensive  বা সর্বার্থ , ব্যাপক।  ২) A-nalytical বা বৈশ্লষিক । ৩) M-ethod  বা কার্যসাধনের ধরণ বা প্রণালী বা নিয়ম। ৪) P-lanning  বা পরিকল্পনা প্রণয়ন। ৫) U-niversity  বা বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রাঙ্গণ । ৬) S-ystem  বা ব্যবস্থা।

এই শব্দ সংবন্ধন  অনুসারে , শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, ব্রত ও দর্শন হল, “শিক্ষার্থীদের সার্বিকভাবে সামাজিক করে তোলা যাতে তারা তাদের ভবিষ্যৎ সামাজিক জীবন যাপনের ধরণ ও নিয়মাবলী সুপরিকল্পিতভাবে নির্ধারণ করতে পারে।“  এই লক্ষ্য পূরণের মধ্যে দিয়েই আবহমানকাল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠান তার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রিসোর্স বা উপকরণ সম্পদকে গড়ে তোলে ও ব্যবহার করে। এই রিসোর্স বা উপকরণের অঙ্গ হল তার শিক্ষক মণ্ডলী, ক্যাম্পাস প্রধান ও সাহায্যকারী স্টাফবর্গ । সাধারণ অভিজ্ঞতা অনুসারে, অভিজ্ঞতা ও বয়স ব্যতিরেকে  শিক্ষক মণ্ডলীর শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে, তাঁদের সঙ্গে ক্যাম্পাস প্রধানের প্রায় কোন পার্থক্য থাকে না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যদি উল্লম্ব প্রশাসনিক বিধিনিষেধ ক্যাম্পাস প্রধান আরোপ করেন, তা’হলে শিক্ষক মণ্ডলী নিয়ে গঠিত “লাইন এককে” এক ধরণের যান্ত্রিক নিষ্ক্রিয়তা বা নির্লিপ্ততা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। তাই পরিবর্ত হিসাবে ‘আনুভূমিক পরিচালন’ পদ্ধতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশী কার্যকর বলে মনে করা হয়। কারণ শিক্ষা তার লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে যে সম্পদ সৃষ্টি করে ,তার মৌলিক চরিত্র ‘বিষয়গত’ নয়, ‘বিষয়ীগত’ । এই উদ্দেশ্য সম্পাদনে প্রতিষ্ঠানের স্টাফ –একক অপেক্ষা “লাইন একক”- এর ভূমিকা অনেকবেশী সদর্থক।
ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এই সদর্থক ভূমিকার সফল রুপায়নের প্রধান দায়িত্ব, ক্যাম্পাস প্রধানের। বর্তমানে এই ভূমিকা পরিমাপের কিছু বিজ্ঞান সম্মত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক মাত্রা চিহ্নিত করার চেষ্টা  হচ্ছে। এই মাত্রাটি হল ঃ-

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি ও শিক্ষা প্রদানের গুনগত মাত্রা বোঝাতে, আমরা হিসাব করি, একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা গ্রহণের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে, বিভিন্ন বিষয়ে কত সময় পেলে তার উক্ত বিষয়গত শিক্ষা সম্পূর্ণ হতে পারেঅর্থাৎ, যে কটি বিষয়ে “ব্যাপক বিশ্লেষাত্মক জ্ঞান” লাভের “পরিকল্পনা”  নিয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে, সেই বিষয় গুলিতে তাকে দক্ষ করে তুলতে, মোট কত সময় তার জন্য বরাদ্দ করা দরকার। এই প্রয়োজনীয় সময়টাকে আমরা সেই শিক্ষার্থীর “ক্রেডিট আওয়ার” বলে চিহ্নিত করি।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব হল, এই ক্রেডিট আওয়ার প্রদানের পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। তার জন্যই তাঁকে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে “শিক্ষক মণ্ডলী এককের” যৌথ সহায়তায় এবং স্টাফ এককের সম্মিলিত পরোক্ষ সাহায্যে “ক্রেডিট আওয়ার পরিকল্পনা” তৈরী করতে হয়। “ব্যবস্থা গত” ভাবে, “ক্রেডিট আওয়ার” এবং “ক্রেডিট আওয়ার পরিকল্পনার” মধ্যে সমানতা বা সঠিক ভারসাম্য সৃষ্টি হলে, তবেই দাবি করা যায় , “শিক্ষার্থী তার নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষের সময় সীমার মধ্যে তার পঠিত বিষয় বা বিষয়গুলিতে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছে।“ ক্যাম্পাস প্রধান এই সমানতা বা ভারসাম্য উল্লম্ব প্রশাসনিক উপায়ে করবেন, অথবা, আনুভূমিক পরিচালন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে করবেন, সেটা নির্ভর করে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাবের উপর। তাঁর এই মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিই “ক্যাম্পাস পরিচালন ব্যবস্থার” চরিত্র নির্ধারণ করে।

অন্যদিকে কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের “সামাজিক চাহিদা” এবং তার “শিক্ষা প্রদানের সক্ষমতা”-র সামাজিক ও আর্থিক বিনিময় মূল্য নির্ধারণের মুখ্য নিয়ন্ত্রক হল ঃ “উক্ত প্রতিষ্ঠানের  ক্রেডিট আওয়ার ও ক্রেডিট আওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে (১) সমানতা বা ভারসাম্য সৃষ্টি করার  সক্ষমতা এবং  (২)পরিকাঠামোগত সহায়তা প্রদানের বাস্তব পরিস্থিতি।“ এই দুটি নিয়ন্ত্রককে ইতিবাচক ভাবে সম্ভাব্য শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সামনে তুলে ধরার জন্য, প্রতিষ্ঠানকে তার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিকাঠামো বিষয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে, ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে দিয়েই এই বিজ্ঞাপন বিস্তারিত হয়।

এইবার আমরা আমাদের আলোচনার শেষ অংশে এসে, সংক্ষিপ্তভাবে দেখার চেষ্টা করব, “কেন একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই প্রাথমিক স্তর থেকে, উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত ক্রমেই সরকার পোষিত স্কুল কলেজ গুলি, পিছনের সারীতে চলে যাচ্ছে; আর তার স্থলে শিক্ষা- বান্ধবগ্ণের বাণিজ্যিক মূলধনে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি মধ্যবিত্ত ও নব-বিত্তশালীদের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে!!”

একটা কথা ঠিক, যে, বর্তমানেও চাকরী বা পেশার জগতে, ইংরাজীভাষায় কথা বলতে দুরস্থ এবং ইংরাজি কেতায় চোস্ত প্রার্থী অন্যের থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকে। যাকে পরিভাষায় আমরা বলি স্মার্ট। চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত থেকে নব্য বিত্তশালী সকলেরই বিশ্বাস, এই বৈশিষ্ঠ্য কেতাদুরস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যে যতটা আয়ত্ব করা যায় , ততটা সরকার পোষিত স্কুল কলেজ থেকে আয়ত্ব করা  যায় না।

এর চেয়েও গুরুত্ব পূর্ণ হল, ক্রেডিট আওয়ার ও ক্রেডিট আওয়ার পরিকল্পনার বিষয়টি। বাণিজ্যিক মূলধনে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রয়োজনের ভিত্তিতে “চুক্তি ভিত্তিক” শিক্ষক উপদেষ্টা ( Teaching Counsellor ) নিয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। উপদেষ্টার শিক্ষাগত যোগ্যতা অপেক্ষা  তার উপস্থিতিটাই গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই স্বেচ্ছামূলক বিশেষ ক্ষমতা সরকার পোষিত স্কুল কলেজগুলিতে নেই। বিশেষ করে সরকার পোষিত স্কুল কলেজগুলির আর্থিক সামর্থ্য ও স্বাধীনতা কম থাকার কারণে, তারা সময়ভিত্তিক উপযুক্ত উপদেষ্টা নিয়োগ করতেও পারে না। ফলে ক্রেডিট আওয়ার ও ক্রেডিট আওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে অপূর্ণতা বা ফাঁক অনেক বেশী থাকে। কারণ মনে রাখতে হবে, সরকার পোষিত স্কুল কলেজগুলি হল, সরকারের অলাভজনক সামাজিক পরিষেবা ক্ষেত্র। কিন্তু ব্যাক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মূলধন বিনিয়োগের লাভজনক ক্ষেত্র হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে বলেই, বাণিজ্যিক মূলধন সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়াও, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চাকরী বাজারের ছোটবড়  চাকরী প্রদানকারী  (Service Provider) সংস্থা গুলির সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে চলে, যাতে তারা তাদের সংস্থার “প্রোডাক্ট” –কে বিজ্ঞাপিত করাতে পারে।

উভয় ক্ষেত্রের শিক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমি কিছু আলোচনা করলাম না। কারণ তার জন্য আরও গবেষণা ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পুনপরীক্ষ্ণ যোগ্য উপাত্ত ও জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। তাই বিষয়টি এখানে অনূলেখ্য রাখাই শ্রেয়।

.            

...