Monday 9 November 2015



আমার রোজনামচার পাতা থেকে ঃ- ০১                            সুজিত নারায়ন চট্টোপাধ্যায়


আমরা এখন এক আশ্চর্য কর সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। নিজেরাও বিশ্বাস করতে পারছি না সময়ের গতি আর চাহিদা । একদিকে বিশ্বায়ন অন্য দিকে উদারীকরণ, সব কিছু মিলিয়ে, এ যেন  এক গোলকধাঁধা। যাকে বলে ভুল্ভুলাইয়া, একদিকে  ঢুকে যখন অন্য দিক দিয়ে বেরোচ্ছি, তখন মনে হচ্ছে, না এ দিক তনয় ত আমি চাই নি আমি অন্য কিছু চেয়েছিলাম,  কিন্তু কি চেয়েছিলাম , তা’ও ঠিক করে বলতে বা বোঝাতে পারছি না। মনে হচ্ছে , বোঝাবোই বা’ কি করে । আমিও ত’ ঠিক জানি না, কি চেয়েছিলাম ! অনেক টাকা , অনেক প্রতিপত্তি, অনেক ক্ষমতা, অনেক জিনিষ, যা আমরা এতদিন পেতাম না। কেবল দেখতাম ছবিতে, আজ সেই সব কিছু পাওয়ার জন্য আমার সব কিছু চাই।

সব কিছু চাই, কিন্তু কোন সব কিছু ? সব কিছু, যা টাকা দিয়ে কেনা যায় ? সব কিছু,  যা প্রতিপত্তি দিয়ে পাওয়া যায় , অথবা না পেলে হরণ করা যায় ?  সব কিছু, যা আমার অপার ক্ষমতাকে প্রকাশ করতে সক্ষম ? কিন্তু কে চায় ? কারা চায় ? আমরা সবাই , না, আমি ? আমি একা না পেলে, আর কেউ যেন না পায়। আমার সঙ্গে কেউ কেউ বা কোন কোন ব্যক্তি, যদি পায়, তবে হয়তঃ কোন আপত্তি করব না , কিন্তু আমার সাথে সবাই যদি পায় তা’হলে অবশ্যই আমার আপত্তি আছে। কেননা সবাই পেলে আমার পাওয়াটার মধ্যে কোন বিশেষত্ব থাকে না আমার ক্ষমতা প্রতিপত্তি আর অর্থের প্রমান প্রতিষ্টিত হয় না। 

এটা প্রতিষ্টিত করতেই হবে, যে আমার সেই সব কিছু আছে, যার দ্বারা আমি আমার ইচ্ছামত অনেক কিছু পেতে পারি। আমার এই চাওয়া পাওয়ার পেছনে সব সময় আমার অভাব কাজ করছে এ’কথা ভাবার কোন কারণ নেই। আসলে বেশীভাগ ক্ষেত্রে করছে না। যেটা করছে তা’হল আমার দিশা হীন অভাব বোধ। এই বোধ আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি এটার দ্বারা পরিচালিত হই । এ’কে পরিচালনা  করার ক্ষমতা  আমার নেই। আসলে হয়তঃ ইচ্ছাটাও নেই। কিংবা এই “বোধ” সম্পর্কে আমার কোন চেতনাও নেই। তাই আমার চাহিদা এই “বোধ”- কে সৃষ্টি করে নি। বরং এই “বোধ”-ই আমার চাহিদাকে সৃষ্টি করেছে। আমার চারপাশ থেকে যদি এই “বোধ” উঠে আসত, তা’হলে হয়তঃ নিজেকে সবার মাঝে স্থাপন করে সামাজিক পারিবারিক, ও ঐতিহ্য যাত “বোধের” মধ্যে দিয়ে চাহিদাকে প্রশাসিত করত। কিন্তু উদার স্বাতন্ত্র্যবাদ সেই পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই “বোধ” শুধুই আমার স্বাতন্ত্র্য সম্পন্ন বোধ। এর সাথে সমাজ পরিবার, শিক্ষা ঐতিহ্য কোন কিছুরই কোন যোগ নেই। এর পশ্চাতে কোন মূল্যবোধ নেই। উদার এই “বোধের” পশ্চাতে আছে “সমাজ অনুদারতার” স্পষ্ট ছাপ। স্বকৃত ব্যক্তি- কেন্দ্রিক উদার মূল্যবোধের তীব্র উপস্থিতি।

এক কথায় আমি যা চাই তা’ সর্বার্থে চাই, কোন রকম আপোসের  মধ্যে দিয়ে চাই না, অথবা কারুর সাথে আমার “বোধ” আর “চাহিদার” আপোস, আমি চাই না। আমি মনে করি, তা’হলে আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হবে। আমার স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হবে। ‘আমি আর তা’হলে আমি থাকব না, আন্যের ক্ষমতায় পরিচালিত এক স্থবির ব্যক্তিত্ব হীন পরাধীন জীবে পরিণত হব।‘ অতএব “আমার স্বাধীনতা : আমার স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে আছে; আমার স্বাধীনতা :আমার বিশ্বায়ন বোধের মধ্যে আছে ;আমার স্বাধীনতা: আমার উদার বোধের মধ্যে আছে।“ 

এই মূল্যবোধ এক নতুন মুল্যবোধ। আমরা যারা বিংশ শতকের মাঝের দিকে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি , তাদের কাছে বিংশ শতকের শেষের দশকের আগে এ’ছিল এক নতুন পাওয়া মূল্যবোধ। বিশ্বায়ন আর উদারীকরনের পথ ধরে এই মূল্যবোধ এসেছে, এক নতুন হাওয়া সৃষ্টি করেছে। নতুন এই হওয়ার বিহ্বল করে গন্ধে আমোদিত হয়ে ভেসে যেতে চাইছি, কিন্তু দিশা পাচ্ছি না । হাওয়ার বেপুথে দমকে বার বার ধাক্কা খাচ্ছি। থমকে যাচ্ছি । ভাবছি এ’ ত আমার ছিল না। কোথা থেকে এল? এ’ আমায় কোথায় নিয়ে যাবে?   

বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাদের জন্য লিখেছিলেন, রাম বড় ভাল ছেলে। সে তার বাবা, মা আর গুরুজনদের কথা শোনে । মন দিয়ে লেখাপড়া করে। আর রাখাল কারোর কথা শোনে না। কেবল নিজের কথা শোনে। প্রত্যহ লেখাপড়া করে না। এরপর আর কিছু লেখেন নি। লেখেন নি তাঁর চিন্তা চিরন্তন কি’না। এখন আর রামকে বড় একটা দেখা যায় না। রাখালদের রমরমা । এখন শুধু নিজের কথা শোনার সময়। অন্যের কথা শোনার সময় কোথায়? বিশ্ব সমাজে আমার স্বাতন্ত্র্য , আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হল, নিজের বিষয়টা বুঝে নেওয়া। বিশ্বায়নের গনতন্ত্র আমায় কিছু সাংবিধানিক অধিকার দিয়েছে। তা যদি সুরক্ষিত না হয়, তবে আমি প্রতিবাদ করব। বাস্তবের জগতে কাউকে না পাশে পেলে, অ-প্রকৃত জগতে তার খোঁজ করব। কারন সেটাই হল আজকের সবচেয়ে সক্রিয় এবং ক্ষমতা সম্পন্ন বিশ্ব জগত ।  

No comments:

Post a Comment